১০. হজযাত্রীর করনীয় ঃ

১০. হজযাত্রীর করনীয় ঃ মনে রাখবেন, আমরা কোন আনন্দ ভ্রমনে যাচ্ছি না। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফরের যাত্রী আমরা। জীবনের সবচেয়ে উত্তম খরচ করতে চলেছেন। এ সফর গুনাহ মাফের সফর। দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবীর সফর। জান্নাত লাভে ধন্য হওয়ার সফর। লাভবান হওয়ার এ সফর আবার সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনাও থাকে। মক্কা শরীফে যেমন সৎ কাজের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়, তেমনি অপকর্মের জন্য পাপ ও বৃদ্ধি করা হয়। পবিত্র নগরী মক্কায় পাপ বৃদ্ধি পাওয়া বা পাপকে বাড়িয়ে লিপিবদ্ধ করার দলিল-মুজাহিদ (রা.) বলেন-মক্কায় পাপ বৃদ্ধি করা হয় যেমন বৃদ্ধি করা হয় নেকী।(মুসীরুলগারামিসসাফীন-২৩৪।) তাই সাবধান! খুব সাবধান! হজ যাত্রীর জন্য করনীয় ঃ ক) আল্লাহভীতি- উচ্চারণঃ যালিকা, অমাই ইউআজ্জিম শাআইরাল্লাহ ফা ইন্নাহা মিন তাক্বওয়াল ক¦ুলুব। অর্থ ঃ এটাই আল্লাহর বিধান এবং কেহ (আল্লাহর) নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে এটাতো তার কলবের তাকওয়ারই বহিঃপ্রকাশ। তাকওয়া,নিয়্যতের পরিশুদ্ধি, হজের বিধি-বিধান সর্ম্পকে জানা,ভালো মানুষের সাহচর্য লাভের চেষ্টা করা, উত্তম চরিত্র গ্রহণ ও সদাচারন করা, যিকির ও দুআ দুরুদে ব্যস্ত থাকা, কাউকে কষ্ট না দেয়া ও সামর্থ অনুযায়ী সহযোগিতা করা ও ইবাদত কবুলের মৌলিক শর্তাবলী মানা। আপনার আমার আমিত্বকে কুরবানী করা, আমার বলতে কিছ্ইু নেই। রাগ-ক্রোধ, হিংসা, ঝগড়া, গিবত, সব কিছুকে চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করা। হজ সফরে কষ্ট সহ্য করার জন্য মানুসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা। আল্লাহ তায়ালা ফরমান- বাংলা উচ্চারণঃ অ-মাই ইউরিদ্ ফিহি বিইল্হাদিম্ বিজুলমিন নুুজিকহু মিন আজাবিন আলিমিন। অর্থ- এবং যে মসজিদে হারামে অন্যায়ভাবে কোন ধর্মদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছা করে আমি তাকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দেব। খ) প্যাকেজ নির্ধারণ-আপনি কোন ধরনের প্যাকেজে হজে যাচ্ছেন তা মাথায় রাখা। আপনি যে প্যাকেজে হজে যাচ্ছেন এই প্যাকেজে কি কি সুযোগ সুবিধা আছে তা মাথায় রাখা। বেশী সুযোগ সুবিধা আশা না করা। এজেন্সীর লোক আপনাকে খুব কম সহযোগিতা করবেন এ চিন্তা মাথায় রাখা, যেখানে যে সহযোগিতা লাগবে এজেন্সীর লোক আশা করি করবেন, তারপরও নিজের কাজ নিজে করতে হবে, প্রস্তুত থাকা। আপনার হজ আপনাকেই করতে হবে এই মানুসিকতা নিজের মধ্যে তৈরি করা। গ) যা করবেন না,পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনায় আসার পর-কোন হাজী কতো টাকা দিয়ে হজে এসেছেন তা জানতে না চাওয়া, কারন আপনার রেট এজেন্সীর সাথে বনিবনা হয়েছে বিধায় আপনি তাদের সাথে হজে এসেছেন। দুনিয়ার রীতি-নীতিতেই সবার সাথে সমান আবদার রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। জানতে চাইলে কি হয়, জানেন ? হয়তো অন্য হাজী আপনার থেকে কিছু কম টাকা বা বেশী টাকা দিয়ে হজে এসেছেন, কম শুনলে তার মন খারাপ, আবার বেশী শুনলে আপনার মন খারাপ। তখন উভয়ের মাঝে এজেন্সীর প্রতি বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রেট এজেন্সীর সাথে বনিবনা করেই তো আপনি হজে এসেছেন তাই নয়কি? সুতরাং রেট যাচাই বাছাইয়ের সময় এখন না। এখন ইবাদতের সময়। ঘ) হজের প্যাকেজ যাচাই-বাছাই আপনি ক্ষতিগ্রস্থ কারণ ---- ০১) ইবাদতে মন বসে না। ০২) এজেন্সীর প্রতি রাগ-ক্রোধে ফেটে পড়েন। ০৩) আমি উনার এতো কাছের লোক আমার সাথে এ আচরন করতে পারলো ০৪) হুমকি ধমকি দেয়া তাকে দেখে নেবেন ইত্যাদি তাতে ফলাফল দাড়ায়- যে উদ্দেশ্যে মক্কা মদিনায় আসা তা আর হয়ে উঠে না। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই। আপনি মনে রাখবেন, মনে করেন আপনি সন্তানের বাবা-মা, আপনার ধারা কি কখনো খেতে বসে সবার প্লেটে সমান মাছ-গোস্ত দেয়া, সম্ভব হয়েছি কি? তাহলে প্যাকেজের ক্ষেত্রে এজেন্সীর মালিক আপনার সাথে এক রকম আচরণ টা করবেন কি করে। কোন না কোন কারনে অকারনে কিছু কম-বেশী করতে হয়। তাতে মন খারাপের কিছু নাই বা তাতে আপনার চেয়ে অন্যকে প্রাধান্য বা অন্যকে গুরুত্ব বেশী দেয়া বুঝায় না। মূল্যের কম-বেশি হলে ৫/১০ হাজার টাকার মাত্র। তাতে মন খারাপের কিছু নাই। যিনি কম দিয়েছেন তিনি অনেক লাভবান হয়েছেন তা কিন্তু নয়। ঙ) মনে রাখবেন- আপনি এমন এক জায়গায় অবস্থান করছেন যেখানে বাবা আদম(আঃ) হতে আমাদের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এবং তার থেকে অদ্য পর্যন্ত কত নবী-রাসুল, অলি-আউলিয়া, সুহাদা ছালেহীন এই পবিত্র মাশাইর মক্কায় এসেছেন। নিজেদেরকে উৎস্বর্গ করে নিজেরা ধন্য হয়েছেন। আপনি সে পথের একজন সৌভাগ্যবান পবিত্র যাত্রী । আলহামদু লিল্লাহ। সুতরাং ইবাদতের পরিবেশ ঠিক রাখতে যা যা করা দরকার আপনাকে তা করতে হবে। যেমনঃ- ০১) অশ্রæসিক্ত নয়নে কান্না-কাটি করা। ০২) কথা কাজে অন্য ভাইকে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার মানুসিকতা থাকা বা রাখা। ০৩) প্রতিদিন পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ দুই হারামেই (মক্কা ও মদিনায়) তাকবীরে উলা জামাতের সাথে আদায় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। ০৪) কথা কম বলা বা অহেতুক আড্ডায় মশগুল না থাকা। ০৫) প্রয়োজন ছাড়া বাসায় অবস্থান না করা। ০৬) বেশী বেশী তাওয়াফ করা ও দু’আ কবুলের জায়গাগুলোতে নিজের জন্য, মা-বাবা, পরিবার-পরিজন, শশুড়-শাশুড়ী, আতœীয়-স্বজন ও সকল মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর কাছে দ’ুআ করা। চ) সহযোগিতার হাত প্রসারিত করুন- একজন অপর জনকে যে কোন সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা। এই সহযোগিতা হউক আপনার গ্রæপের কেউ বা বিন দেশী কোন লোক বা আপনার হজ এজেন্সীর। আমরা আমাদের দেশের হাজীদেরকে সহযোগিতার চেয়ে, বেশী সহযোগিতা করি বিন দেশী কোন ভাই/বোনকে তাতে সমস্যা নাই, কিন্তু আপনার দেশী ভাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল করবেন না। সহযোগিতার মানসিকতা আপনার হজকে আল্লাহর দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই সহযোগিতা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, দুনিয়াবী কোন লোভে বা লাভে নয়। যেমন আল্লাহ পাক ফরমান- ওয়া তাআ’অনু আলাল র্বিরে অত্তাকওয়া, ওয়ালা তাআ’অনু আলাল ইছমে ওয়াল উদওয়ান।) অর্থ-সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমা লঙ্গঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। চ) মিনার তাবু- মিনার তাবুতে একজনের জন্য ১৮ ইঞ্চি মাপের একটি করে ফোম দেয়া আছে, যা আমাদের কোন রকমে থাকার ব্যবস্থা, এতে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একাই ২/৩টি ফোম দখল না করা। আরাফাতের তাবুতে কোন ফোম নাই শুধু মাটিতে কার্পেট বিছানো আছে, প্রত্যেক এজেন্সীর জন্য তাবু আলাদা করা আছে, আপনার এজেন্সীর নাম ও মুয়াল্লিম নাম্বার দেখে প্রবেশ করবেন। সেখানেও জায়গা খুব কম, মিলে-মিশে সবাইকে একই তাবুতে থাকতে হবে। আরাফাতের তাবুতে নিজের ব্যবস্থাপনায় মহিলাদের জন্য (চাদর ক্লিপ দিয়ে) আলাদা করে পর্দা করে দিতে হবে। মাত্র এক রাত। মিনা ও আরাফাতে খানা তাবু পর্যন্ত এজেন্সী বা হাজী সাহেবগন মিলে-মিশে পৌঁছাবে, যার যার খানা নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করবেন এবং খাবেন। খাবার পানি তাবুর বাহিরে পটে বা ডামে বা বোতলে দেয়া আছে। তাবু যাতে নোংরা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। তাবু পর্যন্ত খানা নিয়ে আসতে সবাই সহযোগিতা করুন। ছ) জিলহজ মাসের ৭ তারিখ-হাজীর সংখ্যা বেশী হওয়ার কারনে, হজ পালন যাতে কষ্টসাধ্য না হয় সে বিবেচনায় মক্কার হজ প্রসাশন জিলহজ মাসের ৭ তারিখ দিবাগত রাতে হাজীদেরকে মিনার তাবুতে এবং জিলহজ মাসের ৮ তারিখ দিবাগত রাতে আরাফাতের তাবুতে নিয়ে যায়। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ পবিত্র হজ। জ) মিনায় রাত্রিযাপন ও পাথর নিক্ষেপ-সুস্থ-সবল নারী ও পুরুষ সকলে (সম্ভব হলে) পাথর নিক্ষেপের দিনগুলো মিনার তাবুতে কাটানোর চেষ্টা করবেন, অতি উত্তম, ছাওয়াবের কাজ। বড় জামারাতে পাথর মারার পর কেউ কুরবানী করে হালাল হবেন আবার কেউ কুরবানী না করে হালাল হতে পারবেন, যার যে হালাত সে তা ই করবেন। তা আপনার গাইড বা এজেন্সীকে জিজ্ঞেস করে করবেন, গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ঝ) ফরজ তাওয়াফ- আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে জিলহজ মাসের ১০ বা ১১ তারিখে ফরজ তাওয়াফ করা যায় কিনা? করতে পারলে অনেক ভালো হয়, তাওয়াফ শেষে হাজীর নিজ খরচে আবার মিনার তাবুতে চলে আসবেন। ১২ তারিখে ফরজ তাওয়াফে প্রচন্ড ভীড় হয়। জিলহজ মাসের ১০,১১ ও ১২ তারিখে ফরজ তাওয়াফ করা যায়, আমাদের মাযহাব মতে। অন্যান্যদের মতে মক্কা থাকা অবসস্থায় যে কোন দিন ফরজ তাওয়াফ করা যায় বা দেশে ফিরে আসার পূর্বে হজের মাসের মধ্যে ফরজ তাওয়াফ করলেই হলো। মহিলাগণ মাসিক অবস্থায় ফরজ তাওয়াফ করতে পারবেন না, সুস্থ হলে পরে করতে হবে। ফরজ তাওয়াফ অন্যকে দিয়ে করানো যায় না। ঞ) খানা-পিনাঃ-বাংলাদেশী খানা আশা করা, খানা ভালো না লাগা , আমি গরু খাইনা,মুরগি খাইনা, এগুলো কোন খাবার হলো নাকি, এ সমস্ত মন্তব্য করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখুন। সৌদি আরবের খানা- বাজার-তরকারী-মরিচ-টমেটো ইত্যাদি আমাদের বাংলাদেশের মতো এতো সু-স্বাদু নয়। খানা আপনার ভালো না লাগলে, আপনি নিজে কিনে খানা খাবেন। এজেন্সীর কাছ থেকে হিসেব করে টাকা নিয়ে নিবেন। অহেতুক খানা সর্ম্পকে বিরুপ মন্তব্য করে বিশৃংখলার সৃষ্টি করবেন না। এ সফরে আপনি একা নয়। স্থায়ী বাসা বা কাছের বাসায় হজের আগে ৩/৪দিন এবং হজে পরে ৩/৪দিন হাজীদের কাছের বাসাতে সময়মতো খানা পৌঁছানো, কত যে কঠিন কাজ তা আপনারা জানবেন না বা বুঝবেনও না। এ দিনগুলোতে খাবার আপনার দোরগুড়ায় পৌঁছলো কিনা, পৌঁছে থাকলে আলহামদুল্লিাহ বলুন। দেরি হওয়ার কারনে কৈফিয়ত চাবেন না। খানা খুব-বেশী দেরি হলে প্রয়োজনে আপনি খেয়ে নিন, এক দু বেলা খানা কত টাকাই বা লাগবে, সমস্যা নাই দরকার মনে করলে পরে এজেন্সীর কাছ থেকে চুপে চুপে এক বেলা খানার টাকা চেয়ে নিয়ে নিবেন। ত) বেশী বেশী তাসবীহ, তাহলীল, দুআ, দরুদ ও ইসতিগফার ইত্যাদি পড়া, তাওয়াফ করা ও কাবা ঘরের দিকে ফিরে বসে তাকিয়ে থাকা। বাসায় প্রয়োজন না থাকলে হারামে অবস্থান করা। পবিত্র কাবা ঘরে আল্লাহ তাবারাকা ও তায়ালা প্রতিদিন ১২০টি রহমত নাযিল করেন। সুবহানাল্লাহ। এর মধ্য থেকে ৬০টি রহমত শুধুমাত্র তাওয়াফকারীদের জন্য, ৪০টি সালাত আদায় কারীদের জন্য আর ২০টি রহমত কাবার প্রতি দৃষ্টিদানকারী ও অন্যান্য ইবাদত কারীদের জন্য। যতোদূর সম্ভব ইবাদতের মধ্যে নিজেকে মশগুল রাখুন বা থাকুন। কাবা ঘরের তাওয়াফ এমন একটি ইবাদত, এই ইবাদতটি পৃথিবীর আর কোথাও নাই বা করা যায় না।